গরুর লাম্পি রোগের লক্ষণ ও প্রতিকারের উপায় জেনে নিন

 প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যে দেশে দেখা দিয়েছে 'লাম্পি স্কিন ডিজিজ' বা এলএসডি নামের আরেকটি ভাইরাস। এই ভাইরাস গবাদি পশুকে আক্রমণ করে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক গরু এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। প্রতিষেধক না থাকায় গরু নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে খামারিদের। এলএসডি গবাদি পশুদের জন্য একটি ভয়ানক ভাইরাল চর্মরোগ, যা খামারের ক্ষতির কারণ।

গরুর লাম্পি রোগের লক্ষণ ও প্রতিকারের উপায় জেনে নিন

এটা জানা যায় যে 1929 সালে এই রোগটি আফ্রিকা মহাদেশের জাম্বিয়াতে প্রথম দেখা দেয়। 1943 থেকে 1945 সালের মধ্যে এটি মহাদেশের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। মশাবাহিত রোগটি মূলত মশা দ্বারা ছড়ায়। আক্রান্ত গরু সুস্থ হতে অনেক সময় নেয়। গরু-বাছুর দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যু পর্যন্ত। এটি একটি খামারকে আর্থিকভাবে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে পা-এবং-মুখের রোগের চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক রোগ।

বাংলাদেশে 2019 সালে চট্টগ্রামে গবাদি পশুর গলদা চর্মরোগ প্রথম দেখা দেয়। এরপরই মাঠে নামে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তদন্ত দল। সে সময় দেশের ১২টি জেলার ৪৮ হাজার গরুতে এ রোগের উপসর্গ পাওয়া যায়। এ বছর আবারও এ রোগ দেখা দিয়েছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। কৃষি তথ্য সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি আফ্রিকা মহাদেশে এই রোগে ৪০ শতাংশ গরু মারা গেছে।

রোগের কারণঃ এটি মূলত পক্স ভাইরাস বা লুম্পিং স্কিন ডিজিজ ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট একটি রোগ। ভাইরাসটি Poxviridae পরিবারের অন্তর্গত ক্যাপ্রিপক্স ভাইরাস গণের অন্তর্গত। এই ভাইরাসটি ছাগল এবং ভেড়ার পক্স ভাইরাসের সাথে খুব মিল। এই ভাইরাস গরু ছাড়াও মহিষেও ছড়াতে পারে। এক গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও ছাগল এবং ভেড়ার প্রতিলিপি করা হয়, তারা সাধারণত গলদা চর্মরোগ বিকাশ করে না। উপরন্তু, এই ভাইরাস মানুষকে আক্রমণ করে না।

আক্রান্তের সময়ঃ এই রোগটি প্রধানত বর্ষাকালের শেষে, শরতের শুরুতে বা বসন্তের শুরুতে দেখা যায় যখন মশার প্রকোপ বেশি থাকে।

রোগের লক্ষণঃ এলএসডি আক্রান্ত গরুর প্রথমে জ্বর হয় এবং ক্ষুধা কমে যায়। জ্বরের পাশাপাশি নাক-মুখ থেকে লালা বের হয়, পা ফুলে যায়, দুই পায়ের মাঝে পানি জমে। পশুর শরীরের বিভিন্ন স্থানে চামড়া গলদ হয়ে যায়, লোম গজায় এবং ক্ষত তৈরি হয়। আর এই ক্ষত দ্রুত শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষত থেকে রক্তপাত হতে পারে। শরীরের কোথাও ফুলে যাওয়া। যা মাংসল ক্ষতের মত ফেটে ও বের হয়ে পুঁজ বের করে। পেটে বা মুখে ক্ষত হলে গরুর পানি পানে অনীহা দেখা দেয় এবং খাওয়ার পরিমাণ কমে যায়।

যেভাবে ছড়ায়ঃ রোগটি সংক্রমিত গাভী থেকে অন্যান্য গাভীতে বিভিন্ন উপায়ে ছড়ায়। যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো মশা ও মাছির আক্রমণ। মশা ও মাছিকে এই ভাইরাসের প্রধান বাহক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যান্য পোকামাকড়ের মাধ্যমেও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। সংক্রমিত গরুর লালা এক গাভী থেকে অন্য গাভীতে গো-খাদ্য এবং খামার পরিচারকদের পোশাকের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। আক্রান্ত গাভীর দুধেও এই ভাইরাস থাকে। 

তাই সংক্রমিত গাভীর দুধ খেলে বাছুর সংক্রমিত হতে পারে। গ্রামের পশুচিকিত্সকরা বিভিন্ন গরু ও ছাগলের টিকা দেওয়ার জন্য একটি সিরিঞ্জ ব্যবহার করেন। এটি সিরিঞ্জের মাধ্যমে এক গরু থেকে অন্য গরুতেও ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাসে আক্রান্ত ষাঁড়ের বীর্য প্রজননের জন্য ব্যবহার করলেও রোগ ছড়ায়। শুধুমাত্র গরু, মহিষ ও ছাগলই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়।

প্রতিকারঃ যেকোনো রোগের চিকিৎসা সহজ কিন্তু এই রোগের চিকিৎসা সহজ নয়। এর আগেও এই রোগের আক্রমণ হলেও এই রোগের ভ্যাকসিন সহজলভ্য নয়। তবে খামারের ভেতর ও আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখলে মশার উপদ্রব কমিয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। 

সংক্রমিত গরুগুলোকে খামারের শেড থেকে আলাদা করে মশারি দিয়ে ঢেকে রাখলে অন্য গরুতে ছড়ানো থেকে রোধ করা যায়। আক্রান্ত গাভীকে বাছুরকে দুধ না দিয়ে মাটিতে পুঁতে দিতে হবে। সংক্রমিত গাভীর ব্যবহৃত কোন কিছু সুস্থ গরুর কাছে আনবেন না বা অন্য গরুকে খাবার খেতে দেবেন না। আয়োডিন মিশ্রণের টিংচার দিয়ে ক্ষত পরিষ্কার রাখুন।

প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞদের মতে: এই রোগের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। সচেতনতার মাধ্যমেই এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। রোগের লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হবে। প্রাথমিকভাবে অ্যান্টিপাইরেটিকস এবং অ্যান্টিহিস্টামিন দিয়ে চিকিত্সা করা হয়। নোডুল বা গলগন্ড ফেটে গেলে বা সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ দমন করার জন্য সিস্টেমিক অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। 

এ ছাড়া ভাঙা ব্যাগে মশা যাতে বসতে না পারে তার জন্য ফ্লাই রিপেলেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে 21 দিন পরে, রোগটি সাধারণত সেরে যায়। তাই লম্পি স্কিন ডিজিজের লক্ষণ দেখা দিলে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বা নিবন্ধিত পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url